স্বপ্নার গল্প

0
700

ছেলের স্কুলের টিফিন, বরের অফিসের লাঞ্চ, সবার ব্রেকফাস্ট, এগুলো যেন এখন স্বপ্নতেও আসতে থাকে স্বপ্নার। মাঝে মাঝে ছেলের স্কুলে ছুটির আগে পৌঁছে গেলে স্বপ্না রাস্তার কুকুরগুলোকে দেখে। এদের বাঁচার উদ্দেশ্য কি? খালি খায়, ঘুমায়, দু একবার পালা করে ঘেউ ঘেউ করে, অচেনা কুকুর দেখলে তেড়ে যায় , ব্যাস। মানুষই কি তাহলে এমন প্রাণী, যে ভিন্ন ভিন্ন ছন্দে নিজের জীবনকে চালাতে পারে? তাহলে তার জীবনই শুধু ওরকম অবলা প্রাণীদের মত এক সরলরেখায় চলছে কেন? সকাল থেকে রাতে শুতে যাওয়া অব্দি তার এক রুটিন। আজ অব্দি ওর বর একদিনের জন্য ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে আসেনা। ছুটির দিন মুখ ফুটে বলল না, “চলো আজ চিকেনটা আমি ধরি”। নিজে অফিস, ক্লাব, ট্রিপ সব চুটিয়ে উপভোগ করে। আর ওর ভোগে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে, স্বপ্না নিজেকে ক্ষয়ে যেতে দিচ্ছে।
টেবিলে লুচিগুলো নামায় স্বপ্না। বর ও ছেলের হুকুম এই লুচি আর আলুরদমের। স্বপ্নার যদিও তেলে চোবানো লুচি দেখলে আগে ঘেন্না আসত, এখন আপোস করে নিয়েছে। স্বপ্না যে নিজের মত কিছু রান্না করবে সেটা চিন্তা করারও সময় নেই।

কেউ স্বপ্নার হয়ে চিন্তা করে না। শুধু বর রাত্রে মাঝে মাঝে পাশে এসে বসে। যখন তার শরীর ডাকে, হঠাৎ স্বপ্নার উপস্থিতি টের পায় সে।
“খোকাকে রেডি করে দাও, বেকার দেরি করে লাভ নেই” হুকুম করে বর। একবার দেখার প্রয়োজন মনে করল না যে, স্বপ্নার খাওয়া হয়েছে কিনা। বর যাবে ছেলেকে নিয়ে ভ্যাকসিন দেওয়াতে। অথচ স্বপ্নার যে এখনো ভ্যাকসিন নেওয়া হয়নি, সে খেয়াল নেই। ওর যে কিছু হতে পারে, বা ও যে মানুষ সেটাই হয়ত এ বাড়িতে কেও ভাবে না।
“গো…” স্বপ্নার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল । ‘ ওর’ ম্যাসেজ। সময়ে চলে আসবে বলেছে। একটা আলগা হাসি আসে স্বপ্নার মুখে। আগে বরের সামনে এই ম্যাসেজগুলো এলে অস্বস্তি হত। এখন হয় না। বরও তো ফোন এলেই সাইডে চলে যায়। স্বপ্না কখনো কৈফিয়ত চাই নি। চাইলে উত্তর হয়ত পেত না। বর আর ছেলে ওঠার পর স্বপ্না টেবিলটা দেখে। এঁটো বাসন আর চেবানো উচ্ছিষ্ট পড়ে আছে। ঘেন্না লাগে স্বপ্নার। কিন্তু এগুলো পরিষ্কার করাও তার একটা ডিউটি। এ বাড়ির বউ হওয়ার যে ডিগ্রি সে অর্জন করেছিল, তা থেকেই এ বাড়ির ফায় ফরমাশ খাটার কাজ পেয়েছে।

‘ গো…’ আবার ম্যাসেজ এসেছে। ফোনটা হাতে নেয় স্বপ্না।
“এখন শরীর কেমন আছে?” সত্যি তো, তার শরীর এখন কেমন? খোকাকে রেডি করতে করতে ভাবে সে। কাল রাত্রে জ্বর এসেছিল, বমিও হয়েছিল কিন্তু এ বাড়িতে সেটা নিয়ে কারোর মাথাব্যথা নেই। অথচ ভোর বেলায় ফোনের এপাশ থেকে গোল শুনেই বুঝে গেছিল যে স্বপ্নার শরীর খারাপ।
ছেলেকে নিয়ে বর বেরোনোর সময় স্বপ্নার দিকে তাকিয়ে হেসে গেল। মানে আজ রাতে সে কাছে আসবে। স্বপ্নকেও মেশিনের মত মেনে নিতে হবে। মেশিনও হয়ত মাঝে মাঝে আউট অফ সার্ভিস হয় কিন্তু স্বপ্নাকে সার্ভিস দিয়ে যেতে হয়। একবার ফাঁকা ঘরের দিকে তাকায় সে। এ ঘরের বউ সে। কিন্তু আসলে সে এ বাড়ির হোলসেল সার্ভিস প্রোভাইডার। বা বলা যেতে পারে, শাখা সিঁদুরের বিনিময়ে এ বাড়িতে থাকা এক ক্রীতদাস।

এক ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে নিচে নেমে এল স্বপ্না। বাইরে ‘সে’ অপেক্ষা করছে। আজ স্বপ্না একটু ভালো করে সেজেছে। শরীর খারাপ নিয়ে যতটা হয়। আজকাল ‘ওর’ সাথে আবার আলাপ হতেই সাজগোজ করে স্বপ্না। এগারো বছরে সে ভুলে গেছিল আয়নাটার সামনে দাড়াতে। তারপর আজ সাত আট মাস হল দীপ্তির সাথে আলাপটা হয়। দীপ্তি ওর স্কুলের বন্ধু। শুধু কি বন্ধু ছিল? বন্ধুত্বের মাঝেও যেন অনেকটা বড় আশ্রয়, ভালোলাগা আর কাছে আসার কারণ ছিল। কিন্তু সে সময় এই অসম আবেগে বড় ভয় পেয়েছিল সে। স্বপ্নাকে দেখেই দীপ্তি ছুটে আসে। কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বর কতটা। তারপর ট্যাক্সি ডেকে দুজনে ওঠে। দীপ্তি ওকে জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েই ছাড়বে। স্বপ্নার হাতটা দীপ্তি আঁকড়ে ধরে আছে। সত্যি যখন একটা মানুষ আর একটু মানুষকে মন থেকে জড়িয়ে ধরে তখন শুধু শরীর না, হৃদয়েও দোলা লাগে।

ছেলের স্কুলটা পার হয়ে যাচ্ছে ওরা। স্কুলের সামনের কুকুরটা আর একটা কুকুরের গা চেটে আদর করছে। না, সব প্রাণীরই জীবনে অনেকগুলো ছন্দ আছে। শুধু চেনা ছন্দ ভেঙে , নতুন ছন্দ খোঁজার সাহসটা দেখতে হয়। স্বপ্না দেরি করেছে সেই সাহস দেখাতে, কিন্তু পেরেছে। পেরেছে দীপ্তির জন্য। আলতো করে মাথাটা দীপ্তির কাঁধে রাখে সে। কি বলবেন , আমি দুশ্চরিত্রা ? তবে ওটুকু দুশ্চরিত্রা হওয়ার সাহস আমি নিজের জন্য কুড়িয়ে নিলাম, যাতে দিনের শেষে প্রাণপণে শাখা সিঁদুরের বিনিময়ে হওয়া দাসীর ডিউটি ঠিক ঠাক পালন করতে পারি।

– রজত সাহা©

(ছবি – ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’ সিনেমা)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here