এর আগেও দুবার বারাণসী যাব বলে ঠিক করেছিলাম। দুবারই আমার এক বন্ধুর সাথে। আর প্রতিবারই যাত্রার আগের দিন কোন না কোন কারনে যাওয়া হয়ে ওঠে নি। প্রতিবারই ক্যানসেল টিকিট হাতে দিন গুনেছি, রেলওয়ের দয়াতে আমার সামান্য কিছু টাকা কবে রিফান্ড হবে। এবারও তেমন কিছু হতে পারত, যদি না আমার বোন আমার সঙ্গ দিত। এমনটাই মত আমার বোনের। অবশ্য এইবারে বারাণসীর মুখ না দেখতে পেলে হয়ত সারাজীবনের মত বারাণসীকে মনের বাঙ্কে তুলে রাখতাম।
তা গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি(২০২০) রাত ১০ টা ৪৫ এ কলকাতা স্টেশন থেকে ট্রেন ধরলাম আমরা। আমরা মানে আমি, আমার ঐ বন্ধু, আর আমার বোন। ট্রেনের নাম শব্দভেদী এক্সপ্রেস। ট্রেনে ওঠার পর সহযাত্রী এক বয়স্ক ভদ্রকাকু এই নাম নিয়েই ট্রেনের এমন খিল্লি ওড়াল , যে ট্রেন নির্জীব বস্তু না হলে সব মানুষগুলোকে পেটে নিয়েই আত্মহত্যা করত। ব্যাটা নামেই শব্দভেদী , এদিকে হামাগুড়ি ছেড়ে কবে যে দৌড়বে সেই আশায় বর্ধমান পার করে দিলাম। এদিকে আমার বোন থেকে থেকে আমার দিকে তাকাচ্ছে। একটা তাছিল্ল্যর হাসি মুখে লেগে আছে। এই ট্যুরের সব প্ল্যানিং আমার বোন করলেও শুধু ট্রেন দুটো আমি ঠিক করেছি। আর তাতেই গলদ। এর থেকে বেশি খুশি আমার বোন আর কিসে হতে পারে। এমনিতেই বাবা মা ছাড়া এই প্রথম ‘ও’ আমার সাথে একা বেরিয়েছে। তার জন্য একটা ঠাণ্ডা লড়াই আছেই। কারন বাবা মার সামনে আমাকে পর্যুদস্ত করে, আমায় হাসির খোরাক বানালে ওর রাতের ঘুম ভালো হয়। তাও ভালো মাঝ রাতের ট্রেন বলে খাবারের ঝামেলা নেই। কারন খাবার যেমনই হোক, ম্যাডামের জিভকে যে জয় করতে পারবেনা, তা জানি। ট্রেন বর্ধমান পেরলে নিজের বার্থে উঠে গেলাম। আমার আর আমার বন্ধুর আপার বার্থ,আমার বোন থাকল লোয়ার বার্থে। একবার টুকি মেরে দেখে নিলাম, ম্যাডামের ঘুম বেশ ভালোই এসেছে। আমার বন্ধুটি সদ্য বিবাহিত, তাই সে কি করছে সে ব্যাপারে আমার নাক না গলানোই ভালো। মুশকিল হল আমার। কামরা জুড়ে গগগড়ড় গগগড়ড় নাক ডাকার আওয়াজে কার ঘুম আসে? অগত্যা ভরসা, অরিজিৎ সিং। কানে হেডফোন গুজে পড়ে রইলাম চোখ বন্ধ করে, এই আশাতে যে মুর্শিদাবাদি গলার জোরে ঘুম ঠিক এসে যাবে।
বাথরুমের পাশে বার্থ হওয়াতে মানুষজনের কুল্কুচির আওয়াজ আর শুভকর্মের সুগন্ধে বেশিক্ষণ আর ঘুমাতে পারলাম না। তার উপর উঠেই দেখি এক ভদ্র বিহারী জেঠূ আমার মুখ পানে চেয়ে আছে। আমি উঠতেই , এক গাল গুটখা ভর্তি হাসি হেসে বললেন, “আপকা নিন্দ হো গেয়া তো থোরা হামে মউকা দেঙ্গে?” ভদ্রলোকের আবেদন করার ভঙ্গিতে কিছু ছিল, নাকি তার গুটখাতে কোন জাদু ছিল জানিনা, মন না চাইলেও ঘাড় আপনাআপনি সম্মতি দিল। নিচে এসে দেখলাম মেঝেতে পা ফেলার জায়গা নেই, যে যার মত বসে আছে। তবে, এই না হল বিহার আর উত্তরপ্রদেশ।
অবশেষে আমি নিজে মুখে এক গাল হাসি নিয়ে ট্রেন থেকে নামলাম। কারন ট্রেন একদম সঠিক সময়, ১০ তা ৫ এ বারাণসী ষ্টেশনে এসে পৌঁছেছে। শব্দভেদী নিজের নামের মান রেখেছে। কাশী ঢোকার আগে যে সময়টা গঙ্গার উপর দিয়ে ট্রেন পার হয়, সেই সময় দূর থেকে বারাণসীর ঘাটের যে দৃশ্য চোখে পরে সেটাই ট্রেনে আসার একমাত্র কারন। প্লেন আপনার সময়ের দাম দেবে কিন্তু মনের আরাম? তা শুধু ভারতীয় রেলওয়েই দিতে পারে।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে কোথায় একটু দু চোখ ভরে বারাণসীকে প্রথম দেখা দেখব তা না, মশার ছাঁকের মত একগাদা টোটো আর রিক্সাওয়ালা আমাদের ছেঁকে ধরলো। কেও বলছে ১০০ টাকায় ঘর দেবে, কেও বলছে ৮০০ টাকায়। কেও বলছে ঘাটের কাছে, কেও বলে শ্মশানের কাছে ঘর দেবে। এই জিনিস যে ভাগ্যে আছে তা জানতাম। অনেকে এইভাবেই হোটেল বা ঘর খুঁজে নেন। কিন্তু সমস্যা হল বিশ্বাসযোগ্যতার। আর তাছাড়া হাতে যখন মোবাইল আছে, সমস্যা কিসের? বেশ কয়েকটি বুকিং আপ আছে, তবে আমরা বেছে নিলাম OYO। পেয়েও গেলাম দুটো ঘর মোট ১৫০০ টাকায়। তাও আবার ঘাটের কাছে। শোয়ার জন্য বিছানার জোগাড় হলেও, এবার সমস্যা বিছানার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাহন। টোটো করাই যায়, কিন্তু আমাদের লাগেজ কিছু কম নেই। আলোচনা করছি এমন সময় আমার পিছনে, ঈশান কোন থেকে এক ব্যাক্তি এসে বললেন ২০০ টাকা দিলে একদম হোটেলে ছেড়ে দেবে। কি করব কি করব ভাবছি, ঠিক তখনই উবের থেকে আসে একটি ম্যাসেজ, ‘ওয়েলকাম টু বারাণসী।“ ব্যাস আর কি, ১৪০ টাকায় চলে এলাম হোটেল। আসার পথে দেখলাম সেই শহর, যা একদিকে ইতিহাস, অন্যদিকে সভ্যতাকে বয়ে নিয়ে আসছে দিনের পর দিন। এই শহরের ধর্মীয় ঐতিহ্য জ্বলজ্বল করছে অষ্টম শতাব্দী থেকে। শুধু হিন্দু না, মুসলিম ও বৌদ্ধ ধর্মেরও ঐতিহ্য বহন করে এই শহর। তুলসিদাস তার ‘রামচরিত মানস’ রচনা করেন এই বারাণসীতে । মোট ৮৮ টি ঘাট আছে বারাণসীতে। ইতিহাস, আধুনিকতা, ঐতিহ্যের মেলবন্ধন উপভোগ করতে করতে আমরা পৌছালাম শান্তি গেস্ট হাউস। যদিও গেস্ট হাউস গলির মধ্যে। ২০০ টাকার ট্যাক্সিকাকু কিভাবে আমাদের গলি দিয়ে “একদম হোটেল” পৌঁছে দিতেন তা বুঝতে পারলাম না। যাই হোক, হোটেলের এক একটি রুম ৭৫০ টাকা ধরে নিলে ঘর মন্দ না, তবে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা আর একটু আশা করেছিলাম। যেহেতু আমাদের হোটেলে ঢুকতেই বেলা হয়ে গিয়েছিল, তাই আমরা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে গেলাম ছাদে। আর তাক লাগল তখনই। পুরো হিপ্পি স্টাইলে বানানো অসাধারন এক রেস্টুরেন্ট। যার চারিদিকে বিভিন্ন রং ও হাতে আঁকা ছবির ছড়াছড়ি। অর্ডার দিলাম বিরিয়ানি। সাথে রেশমি চিকেন। বিরিয়ানি দেখতে হলুদ ও সবুজ। খেতে যে খুব খারাপ তা নয়। সব জায়গাই গিয়ে কলকাতার বিরিয়ানি আশা করা যায় না। প্রতি জায়গার আলাদা আলদা স্বাদ। সেটা মানিয়ে নিতে হয়। নিচ্ছিলামও তাই। কিন্তু দুটো জিনিস হজম হল না। এক, বিরিয়ানির সাথে স্যালাড হিসেবে কাঁচা মুলো কেন দিল বুঝলাম না। আর দুই, ক্যামেরা তে ছবি তুলব বলে যেই একটু ঘুরেছি, অমনি আমার বোন ছোঁ মেরে আমার প্লেটের মাংস পিস থেকে অর্ধেক তুলে নিল। যাই হোক, এক মাঘে শীত যায় না। আর শীতকে কিভাবে আটকালাম, তা ক্রমশ প্রকাশ্য।
বিকালের দিকে আমরা বেরলাম। আজ আমাদের তেমন কিছু প্ল্যান নেই। শুধু ঘাটের দিকে ঘোড়া ও সন্ধ্যা আরতি দেখা ছাড়া। আমরা ছিলাম শিবালা ঘাটে। আরতি হয় দশাশ্বমেধ ঘাটে। কিন্তু ঘাটের কাছে আসতেই আর একটা জিনিস চোখে পড়ল। উল্টোদিকে গঙ্গার ঐ পারে পড়েছে বিস্তীর্ন এক চড়। যেন এক টুকরো ছোট্ট মরুভূমি। প্রতিটা ঘাটেই আছে নৌকা। হাতে বোয়া নৌকা, না হলে মোটর চালিত নৌকা। আমরা একটা নৌকা ঠিক করলাম, যেটা আমাদের ঐ চড় ঘুরিয়ে ঠিক সন্ধ্যে নামার আগে সমস্ত ঘাট দেখিয়ে দশাশ্বমেধ ঘাটে আরতি দেখাবে। নৌকায় ওঠা মাত্র মায়ের ফোন। কোন কোন মন্দির গেলাম, কি দেখলাম, নিরামিষ খেলাম কিনা এই সব প্রশ্ন। একটা বছর ছাব্বিশের ছেলের চোখ তখন চড়ের উপর বিভিন্ন আডভেঞ্ছার রাইড দেখে চক চক করছে, তার কাছে তখন কি মন্দির, কি দেবতা, কি নিরামিষ। ভাগ্য ভালো মোটর চালিত নৌকা হওয়াতে, ঘরঘর আওয়াজে কিছু শোনা যাচ্ছিল না ফোনে। তাই বেশি জবাবদিহি করতে হয়নি। যদিও ফোন রাখার পর সেই শব্দ বেশিক্ষন সহ্য করা দুঃসহ হয়ে উঠছিল। চড়ে কি করলাম সে সবে পরে আসছি। কারন সন্ধ্যে নেমে আশায়, প্রথমদিন চড়ে খুব বেশি সময় কাটাতে পারিনি। বরঞ্চ দেখলাম পর পর সব ঘাট। তাও সন্ধ্যের আলোতে। ঘাটের পাড়ে বিশাল বিশাল মহল। তাতে রংবেরঙের আলো জ্বলছে। সব কাটিয়ে এলাম আরতির জায়গায়। নৌকা দিয়েও যে মানুষ লাইন দিতে পারে, তা আমি এই প্রথম দেখলাম। শুরু হল আরতি। মাইকে গঙ্গা আরতির গান আর সামনে সেই অপূর্ব দৃশ্য। আহা, বিশ্বাস করুন, এই বয়েসে আধ্যাত্মিক চিন্তা গড়ে তুলিনি। কিন্তু মনের শান্তি যে কি, তা সেই প্রথম অনুভব করলাম। মা গঙ্গা, তুমি ছিলে তাই বিস্তীর্ন উত্তর ভারত জন্মেছে, লালিত হয়েছে। ভারত সবুজ ও সুন্দর হয়েছে। যুগ যুগ ধরে তুমি কত পাপ নিজের মধ্যে নিয়ে মানুষকে শুদ্ধ করেছ। কিন্তু আমরা পারলাম না তোমায় শুদ্ধ রাখতে। এরা তোমার পুজো করে, সেই ফুল তোমার বুকেই ছুঁড়ে দিচ্ছে পোঁচতে দেওয়ার জন্য। পারলাম না মা, তোমায় শুদ্ধ রাখতে।
ঘাট, ঘাটের পাশে মানুষ, সাধু, মন্দিরের গল্প হবে পরের পর্বে। আজকের পর্ব শেষ যেটা দিয়ে করব সেটা হল বারাণসীর বিখ্যাত চাট ও মালাই। আরতি শেষ হলে নৌকা আমাদের আবার পৌঁছে দিল শিবালা ঘাটে। আমরা হেটে, গলি গলি পথে এলাম মেন রোডে। এবারের গন্তব্য কাচরি গলি। তবে টোটো ধরার মুখে দেখলাম ফুচকার দোকান। আর কি লোভ সামলানো যায়। কিন্তু প্রথমটা মুখে দিয়েই বুঝলাম মাঝে মাঝে লোভ সংবরণ না করলে জীবনটা কেল্টূদা হয়ে যেতে পারে। একটা মুখে নিয়েই খাওয়া বাতিল করলাম। পুদিনার জলে কে ফুচকা খায়? সঙ্গে সঙ্গে টোটো ধরে গেলাম কাচরি গলি। নিলো ৩০ টাকা। সেখানে শুরুতেই খেলাম এক কাপ চা। তারপর লাগোয়া মিস্টির দোকানে ঢুকে দেওয়ালে টাঙানো মেনুকার্ড দেখলাম। সেই ক্লাস এইটে শেষবার দেবনগরী হরফ পড়েছি, তারপরে এইদিন আবার মন দিয়ে পড়লাম। ছয় মিনিটের মাথায় নামগুলো বুঝলাম। সবার প্রথমে রসগোল্লা মুখে নিলাম। তাতে রস বেশ স্পষ্ট। তবে গ্রাম বাংলার মত না, একদম কলকাতার স্পঞ্জ রসগোল্লা। তারপর মালাই ও রাবড়ি। মিষ্টির পর্ব শেষ হলে আমরা ঢুকলাম “কাশী চাট ভাণ্ডার”। আমার বোনের রিসার্চ অনুযায়ী এটা নামকরা দোকান। অর্ডার দিলাম দই ফুচকা, টমেটোর চাট ও পাপড়ি চাট। এর মাঝে টমেটোর চাট জিভে স্বর্গ এনে দিয়েছে। সাথে দই ফুচকাও অসাধারন। আর এখানেই আমি আমার বোঝাপড়া সেরে নিলাম। বোনের ভাগের দই ফুচকা থেকে একটা রেখে বাকি সবগুলোই আমি পেটে ঢোকালাম। বোন কটমট দৃষ্টি নিয়ে হয়ত আমায় কোন অভিশাপ দিচ্ছিল, কিন্তু আমি তাতে তোয়াক্কা না দিয়ে ওর সামনেই একটা ঢেকুর তুলে অর্ডার রিপিট করলাম। বিল হল ১৫০ টাকার কাছাকাছি।
অবশেষে শোয়ার আগে বোনের সাথে আর এক রাউন্ড চুলোচুলি হল, উপলক্ষ খাটের যে দিকে চারজিং প্লাগ, সেদিকে কে শোবে । সে কথা না হয়, নাইবা বললাম। তবে বোনটি আমার ভারি মিষ্টি। দাদার কথা ভেবে, নাকি ঘুমের কাছে হেরে অবশেষে আমাকেই বিছানার দিক বেছে নিতে দিল। আমার বন্ধুটি ততক্ষনে নিজের ঘরে ব্যাস্ত। ঐ যে বললাম সদ্য বিবাহিতদের ব্যাপারে বেশি নাক না গলানোই ভাল।
অবশেষে প্রতিক্ষা পরের দিনের। আরও চেনার আছে বারাণসীকে। এখানকার মানুষ, তাদের বিশ্বাস, রীতিনীতি জানার আছে। মনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা তখন মনিকর্নীকা ঘাট নিয়ে। বারাণসীর অন্যতম বড় শ্মশান। যার আগুন কখনও নেভে না।
দেখা হচ্ছে পরের পর্বে।
Article By Rajat Saha